মেহেদী
মেহেদীর পরিচিতি
মেহেদী মানব সমাজের জন্য প্রকৃতির এক অনবদ্য দান। এর রয়েছে এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল, এন্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি-ইনফ্লেমেটরী, কুলিং, হিলিং ও সিডেটিভসহ অনেক গুনাগুণ যা মানব দেহ ও মনের বিভিন্ন রোগ প্রশমনকারী। তাই হাজার হাজার বছর ধরে মানব জাতি পাথ্য হিসেবে মেহেদী গাছের বিভিন্ন অংশ নানা কারনে ব্যবহার করে আসছে।
ইসলাম ধর্মে মেহেদি
১৫০০ বছর ধরে মুসলিম নারীরা মেহেদী ব্যবহার করে আসছে। নবীজি মুসলিম নারীদের হাতে মেহেদীর নক্সা করাকে উৎসাহিত করতেন। নবী কন্যা ফাতেমা নিয়মিত হাতে মেহেদীর ডিজাইন করতেন। নবীজী নিজেও তার দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করতেন। ইসলামী খেলাফতের সময় থেকে মুসলিম বিশ্বে মেহেদীর ব্যবহার ধর্মীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
রাসূলে পাক (সা:) মেহেদির পাতাকে বিভিন্ন রোগে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন। (১) ফোড়া পাকানোর জন্য (২) শরীরে কাঁটা ফুটলে, (৩) মাথাব্যথায়।- হজরত সালমা বিনতে উম্মে রাফে (রা:) হতে বর্ণিত আছে, ‘যখনই রাসূলে পাক (সা:)-এর কোনো ফোড়া, পাঁচড়া বের হতো অথবা কাঁটা বা এই প্রকারের কিছু ঢুকে যেত, তখনই রাসূলে পাক (সা:) আমাকে বলতেন এর ওপর মেহেদি লাগিয়ে দাও।’ (মিশকাত, তিরমিযী)
অন্যত্র এক হাদিসে ইবনে মাজার বরাত দিয়ে আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম (রহ:) বলেন যে, যখন রাসূলে পাক (সা:)-এর মাথাব্যথা দেখা দিত তখনই তিনি মাথায় মেহেদি লাগাতেন এবং এরশাদ ফরমাতেন, ‘আল্লাহর হুকুমে এটা মাথাব্যথার শেফাদানকারী।’ কিতাবুল মুফরাদাতের উদ্ধৃতি মেহেদি রক্ত পরিষ্কারকারী এবং চর্মরোগের জন্য উপকারী। কুষ্ঠরোগী, আগুনে পোড়া এবং পান্ডব রোগের জন্যও মেহেদির ব্যবহার খুব উপকারী। মেহেদির প্রলেপ ফোলা, ফোস্কা, আগুনে চামড়া পুড়ে যাওয়া রোগীর জন্য খুবই উত্তম প্রতিষেধক। মেহেদির ঠান্ডা বৈশিষ্ট্যের কারণে এটা হয়ে থাকে। (কিতাবুল মুফরাদাত, খাওয়াসুল আদভিয়া, পৃষ্ঠা : ৩৫২)
মেহেদীর ভেষজ ব্যবহার
- জন্ডিস : আঙুলের মতো মোটা মেহেদি গাছের মূল (কচি হলে ভালো) অর্ধভাঙা আতপ চাল ধোয়া পানি দিয়ে ঘষে (চন্দন পাটায় ঘষলে ভালো হয়) দুই চা চামচ পরিমাণ নিয়ে ৮-১০ চামচ ওই চাল ধোয়া পানি মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে দুই বার খেতে হবে। এভাবে চার-পাঁচ দিন খেলে আরোগ্য হয়। এ সময় ডাবের পানি বা আখের রস খেলে কাজ হবে না।
- শ্বেতপ্রদহ (Leucorrhoea) ২৫ গ্রাম মেহেদিপাতা সিদ্ধ করে সেই পানিতে উত্তর বস্তি (ডুস দেয়া) দিলে সাদাস্রাব ও অভ্যন্তরে চুলকানি (Itching) প্রশমিত হয়। স্থানভ্রষ্ট জরায়ুর ক্ষেত্রেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অসুবিধা কমে যায়।
- শুক্রমেহ রোগ : মেহেদী পাতার রস এক চা চামচ দিনে দুই বার পানি বা দুধের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে উপকার পাওয়া যায়।
- মাথা ও চুলের বিভিন্ন রোগে: ইউনানি চিকিৎসকদের মতে চুল উঠে যাওয়া বা পাকায় একটি হরীতকী ও ১০-১২ গ্রাম মেহেদিপাতা একটু থেতো করে ২৫০ মিলি পানিতে সিদ্ধ করে ৬০-৭০ মিলি থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা হলে মাথায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া খুশকি দূর করতেও এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক মেহেদীর ভিতরে এক প্রকারের প্রাকৃতিক এসিড রয়েছে যা এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল যা চুলকে লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে। এটি চুল পড়াও রোধ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ মেহেদীকে বলেছেন পৃথিবীর সেরা কন্ডিশনার। প্রাকৃতিক মেহেদী পেস্ট মাথা ঠান্ডা রাখে ও মাথা ব্যাথা দূর করে। ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল একটি পাত্রে সিদ্ধ করার সময় ৬০ গ্রাম হেনা পাতা ক্রমান্বয়ে যোগ করা হয়; তারপর একটি কাপড় দিয়ে ছেঁকে বোতলে সংরক্ষণ করা হয়। এটি নিয়মিত মাখলে চুলের স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এটি মাথার টাকের চিকিৎসারও সহায়ক।
- স্কীন ও ওরাল ডিজিজ : অত্যান্ত উপকারি ভেষজ হেনার পাতা ও ফুল হতে আহরিত তেল অনেক চর্ম-মলম তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চামড়ায় ক্ষত, পোড়া ও চামড়ার ফ্যাকাসে হলুদ দাগ চিকিৎসায় অত্যান্ত কার্যকরী ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হয়। স্কেবিস, চর্মের চুলকানি জাতীয় ও নখের ফাটার চিকিৎসায় হেনা পেস্ট ব্যবহার হয়। ত্বকের বিভিন্ন রোগ যেমন- একজিমা, খোসপাঁচড়া, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন, ঘা, কুষ্ঠু, শ্বেতী ইত্যাদি রোগে মেহেদিপাতার রস উপকারী। পাতার রস দিনে দুই বার আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এ ছাড়া যাদের গায়ের বা মুখের চামড়া কুঁচকে ঢিলে হয়ে বা ঝুলে গেছে, তারা এই পাতার রস দিয়ে তৈরি তেল মাখলে অনেকটা স্বাভাবিক হবে। গরমকালে যাদের শরীওে ঘাম বেশি হয়ে দুর্গন্ধ হয় তারা বেনামূল (Vetiveria zizanioides) মেহেদিপাতা সিদ্ধ পানিতে গোসল করলে উপকার পাবেন। দেহ হতে পানি হ্রাস প্রতিরোধ করে; আবার ময়েশ্চার ধারণের ফলে কোন অঙ্গ স্ফিতীর রোধে এক প্রকার ডিসল্ভিং ফ্যাক্টর গঠনে কাজে লাগে। হাত-পা জ্বালায় পাতার পেস্ট পুরু করে লাগিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। কারণ মেহেদিতে আছে শীতলকারক উপাদান। গর্ভবতী মায়ের ৮ মাসের সময় তার নাভীসহ গোটা তলপেটে মেহেদীর ভরাট ডিজাইন করলে গর্ভজনিত কারণে চামড়ার ফাঁটা ও দাগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- মানসিক স্বাস্থ্য : অনিদ্রাসহ নানা রকমের মানসিক অসুখের দাওয়া হিসেবে প্রাচীন কাল থেকে মানুষ মেহেদী ব্যকহার করছে। আগের দিনে নবাব বাদশাহদের অনিদ্রা (Insomnia) রোগ হলে ইউনানি চিকিৎসকেরা মেহেদি ফুলের বালিশে ঘুমানোর পরামর্শ দিতেন। ফুলে আছে লাইলাকের (আধুনিক এক প্রকার প্রসিদ্ধ সুগন্ধি) গন্ধ। চরক সংহিতায় বলা হয়েছে গন্ধটি পার্থিব সত্তায় সমৃদ্ধ এবং বায়ুবাহিত হয়ে নাসারন্ধ্র পথে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। তখনই মন হয় অন্তর্মুখী, সেটাই নিদ্রার পূর্বরূপ। আস্তে আস্তে আসে স্নায়ুতন্ত্রের অবসাদ, তারই বাস্তবরূপ তন্দ্রা। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের শরীরে মেহেদীর অলংকরণ থাকে তারা তুলনামূলকভাবে সুখী ও পরিতৃপ্ত মানুষ।
- অন্যান্য রোগ : মাথাব্যাথা, জ্বর ও ভিটামিন-বি এর ঘাটতি জনিত পায়ের পাতার জ্বালা পোড়ার ক্ষেত্রে দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে স্বস্তি প্রদান করতে পারে। এর ফুলের পেস্টের সাথে ভিনেগার মিশিয়ে কপালে প্রয়োগ করলে রৌদ্রজনিত কারণে মাথা ব্যাথার উপশম হয়। গলা ব্যাথা উপশমে হেনা পাতা দিয়ে গরম করা পানি দিয়ে কুলকুচা করা যায় বা আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করা যায়। অস্থিও জোড়ায় প্রদাহ, ফোলা ও থেতলে যাওয়া অঙ্গে পাতার পেস্ট স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করা যায়। মেহেদী পাতার রস ও সরিষার তেল মালিশ করলে ব্যাথা কমে। মেহেদী পাতার রস গরম করে দুই ফোঁটা করে চার-পাঁচ দিন কানে দিলে কান দিয়ে পুঁজ পড়া বন্ধ হবে। আবার অনেকে এই পাতার রস দিয়ে তৈরি তেলও ব্যবহার করে থাকেন। অল্প কয়েকটা পাতা থেঁতো করে, গরম পানিতে ফেলে রেখে কিছুক্ষণ পরে ছেঁকে সেই পানির ফোঁটা চোখে দিলে চোখ ওঠা রোগ ভালো হয়। বাকলের রস জন্ডিস, প্লীহা বড় হয়ে গেলে, কুষ্ঠ এবং সহজে সারে না এমন চর্মরোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনপন্থী বৈদ্য সমপ্রদায়েরর মতে, শরীরে হিমোগ্লোবিন সঠিক পরিমাণে আছে কি না জানার জন্য মেহেদিপাতা ব্যবহার করা হয়। মেহেদিপাতা বাটা হাতের তালুতে লাগালে রঙটা লালচে আভা দিলে ভালো, না হলে হিমোগ্লোবিন কম আছে বলে ধারণা করা হয়।
Comments
Post a Comment